প্রাণবৈচিত্র্য ও বীজের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইকোফেমিনিস্ট মেনিফেস্টো

ফরিদা আখতার
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:০৪

বাংলাদেশের প্রাণসম্পদের হাজার হাজার জাত ও প্রজাতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ একালের নতুন সংগ্রাম। ছবি: উবিনীগ
২০২৩ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ইতালিতে নারীদের একটি ভিন্ন ধরনের সভা হয়েছে। সেই সভায় উন্মোচিত হলো বিশ্বের একমাত্র নারীবাদী ঘোষণাপত্র বা মেনিফেস্টো। এই দিক থেকে সেই সভার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
ঘোষণাপত্রে এই ধরিত্রী রক্ষার জন্য প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষা এবং বিশেষভাবে প্রাণবৈচিত্র্য এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ‘ডাইভার্স উইমেন ফর ডাইভারসিটি’ (Diverse women for Diversity) এই উদ্যোগ নিয়েছে। আমি এই নেটওয়ার্কের সদস্য। আমি ইতালির সেই অনুষ্ঠানে যাইনি, কিন্তু ইশতেহার রচনার প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। সেই কাজটি হয়েছিল ২-৩ মার্চ ভারতের দেরাদুনে ড. বন্দনা শিবার নবধান্য (Nevada Biodiversity Farm) প্রাণবৈচিত্র্য কেন্দ্রের মনোরম পরিবেশে। বন্দনা ও আমি আমাদের আরও অনেক বন্ধুদের নিয়ে এ বিষয়ে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করছি। নয়াকৃষি আন্দোলন ও নবধান্যের মৈত্রী বহুকাল আগের থেকে।
নবধান্যের কেন্দ্রে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় ৩০-৩৫ জন দিনে-রাতে আলাপ-আলোচনা করে প্রায় ৫৮ পৃষ্ঠার একটি দলিল তৈরি করে। ড. বন্দনা শিবা, বলাবাহুল্য, সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং আমাদের গুরুগম্ভীর আলোচনার পাশাপাশি হাসিঠাট্টা, গান, নাচ সবই করেছি। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতি বিনিময়ের আন্তরিক ক্ষেত্রগুলো এভাবেই তৈরি হয়।
আলোচনায় যেখানে আমরা সবাই প্রবল হোঁচট খেয়েছি সেটা হচ্ছে, মানুষের এত যত্নে লালিত প্রাণবৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। এক সময় জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তোলা ধনী দেশগুলো দাবি করত- প্রকৃতি ধ্বংস করার জন্য আমাদের মতো দেশের জনসংখ্যা দায়ী। সেটা ধোপে টেকেনি, কারণ পাশ্চাত্যে বড় বড় শহর, নগর, ব্যবসার কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে বন ও প্রকৃতি ধ্বংস করে। তারা যে বিষ ও বর্জ্য ত্যাগ করে তা বায়ু, জমি ও সমুদ্র দূষিত করছে। শুধু তাই নয়, উপনিবেশ স্থাপন ও বিভিন্ন দেশকে কলোনি বানিয়ে সেই সব দেশকেও তারা ধ্বংস করেছে। প্রাণ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে সকল প্রাণের আবাস গণ্য করে হাজার বছর ধরে যে সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য, জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষা জীবাশ্মভিত্তিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল আধুনিক সভ্যতা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।

পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপজ্জনক মতাদর্শিক দিক হলো বিজ্ঞানের নামে প্রকৃতি ‘জয়’ করা। প্রকৃতিকে প্রাণের আবাস হিসেবে নয়, মানুষের ভোগ্য বিষয় গণ্য করা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সভ্যতা গড়ে ওঠার পর প্রকৃতি পর্যবসিত হয়েছে কারখানার কাঁচামালে আর উৎপাদনের উপায়ে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আমাদের সম্পদ গ্রাস করছে, তাদের মুনাফার জন্য প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। মানুষ নয়, জীবাশ্মভিত্তিক আধুনিক সভ্যতা এবং ভোগ ও মুনাফাতাড়িত উৎপাদন ব্যবস্থাই প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনাশের জন্য দায়ী।
নবধান্যে ইশতেহার তৈরিতে ছিলেন পরিবেশ আন্দোলনকর্মী, একাডেমিশিয়ান, বিজ্ঞানী, পণ্ডিত বা স্কলার, সমাজ গবেষক, মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট, খাদ্য সমবায় সমিতির উদ্যোক্তা এবং আরও অনেকে। সবচেয়ে বেশি যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন মাঠ পর্যায়ে যারা প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষিকাজ করে থাকেন। বাংলাদেশে নয়াকৃষি আন্দোলনের কথা এখন বিশ্বের পরিবেশবাদীরা জানেন এবং নয়াকৃষির চিন্তা-ভাবনার অনন্যতা এবং বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে আলোচিত হয়। আমরা যারা সেখানে ছিলাম, তারা বিভিন্ন দেশ থেকে আসলেও প্রাণবৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, বীজ যে হারিয়ে যাচ্ছে- তাতে সবার উদ্বেগের শেষ নেই। তাই বলে কেউ বসেও নেই। পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণের নারীদের একই উৎকণ্ঠার সুর প্রবলভাবে বেজে উঠেছিল।
সারা বিশ্বের নারীরা এখন জলবায়ু দুর্যোগের শিকার হচ্ছে; এই দুর্যোগের কারণ প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর জীবন ভোগী জীবন-যাপন। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বের একটি প্রধান দিক হচ্ছে মুনাফা লোভী করপোরেশনগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অর্থনৈতিক সম্পদ দখলে নিয়ে নেওয়া। এর ফলে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর প্রচণ্ড হুমকি সৃষ্টি হয়েছে।
নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি সবকিছুকেই বাজারের পণ্যে পর্যবসিত করছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সভ্যতা একই সঙ্গে বর্জ্য উৎপাদকও বটে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাদ্য উৎপাদন কৃষি ধ্বংস করে তাকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশনে পর্যবসিত করেছে।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে গভীর ছেদ ঘটেছে। মানুষের খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে। মানুষ এখন কোম্পানির নিয়মের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে।
মেনিফেস্টো তৈরির সময় এই আলোচনাগুলো বারবার সামনে এসেছে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা আমরা সেখানে শুনেছি। তাই এই মেনিফেস্টোতে সকল ধরনের নারীর কথার প্রতিফলন আছে। ইতালির রোমে ৫ জুন মেনিফেস্টো উন্মোচন উপলক্ষে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বের রাষ্ট্রীয় নেতা, কৃষক পর্যায়ের আন্দোলনের সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন লোভ, অন্যের সম্পদ লুট এবং মানুষের কাছ থেকে প্রকৃতিকে আলাদা করার মতো কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকেন। এর বিপরীতে তারা যেন এতদিন প্রকৃতির যে ক্ষতি সাধন হয়েছে তা মেরামত, প্রকৃতিকে যত্ন এবং এমন অর্থনীতির প্রচলন করার কাজ করেন যা মানুষের জীবন আবার সপ্রাণ, সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষির চরিত্রই এমন যে তাকে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, যন্ত্র, মেশিনপত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। মানুষকে বিদ্যুৎ ও জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর করে তোলে। কৃষিকে লাভজনক করতে হলে এককাট্টা ফসল উৎপাদন করতে হয়। ফলে পরিবেশের ক্ষতি, অন্য সব প্রাণীর আবাস ধ্বংস, প্রাণবৈচিত্র্য সংকুচিত হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস বেশি নির্গত হয়।

দুই.
নারীদের মধ্যে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে, ১৯৯৬ সালে। বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনের (১৯৯২) পর থেকে নারী পরিবেশবাদীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ধ্বংসের লক্ষণ দেখে উৎকণ্ঠা প্রকাশ ও আলোচনা শুরু হয়। কয়েকজন নারীবাদী পরিবেশবিদ ড. বন্দনা শিবা, ড. মারিয়া মিজ এবং ইউরোপ ও আমেরিকার আরও কয়েকজন পরিবেশবিদের সমন্বয়ে জার্মানির লিপজিগ শহরে Plant Genetic Resource সম্মেলনে দেনদরবার হয়। ১৯৯৭ সালে Diverse Women for Diversity (DWD) নেটওয়ার্ক গঠিত হয়। এই সময় থেকেই আমিও এই নেটওয়ার্কের সদস্য হয়েছি। আমাদের ইচ্ছা ছিল শুধু সমালোচনা নয়, বিশ্বকে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের রূপ উপহার দেওয়া।
বন্দনা শিবা ও সদ্য প্রয়াত মারিয়া মিজ এর আগে থেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন; তারা দুজনে ইকোফেমিজম (১৯৯৩) গ্রন্থটি যৌথভাবে রচনা করে বেশ সাড়া জাগিয়েছেন। প্রকৃতি ধ্বংসের অনেক উদাহরণ এবং কীভাবে তার বিপরীতে কাজ করতে হয় সেই কথাগুলো তারা সাজিয়েছেন এই গ্রন্থে। আরও একটি বইয়ের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন; সেটি হচ্ছে ‘The Subsistence Perspective’, লিখেছেন মারিয়া মিজ এবং ভেরোনিকা বেনহডট থমসেন (১৯৯৯)। তারা আর এক ধাপ এগিয়ে উৎপাদন, বিতরণ ও ভোগের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সমালোচনা উপস্থাপন করেছেন এবং একই সঙ্গে একটি নতুন নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনযাপন এবং প্রাণ-পরিবেশ রক্ষার পদ্ধতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা যুক্তি দিয়েছেন যে নারীবাদী হতে হলে আমাদের প্রাণ রক্ষার নীতি অনুসরণ করতে হবে; আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বের মতো প্রাণ ধ্বংস বা হত্যাকারী নীতি পরিহার করতে হবে। আমরা যদি পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী প্রযুক্তির বিরুদ্ধে লড়তে চাই এবং আমাদের শরীর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই তাহলে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার লড়াইয়ে যুক্ত হতে হবে। মারিয়া এবং ভেরোনিকা খুব সহজভাবে বুঝিয়েছেন যে মানুষের সাধারণ দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের যে কাজ বা ইংরেজিতে subsistence activities- ঘরের কাজ, পরিবারের সদস্যদের যত্ন করা, সমাজভিত্তিক উৎপাদন ইত্যাদির কোনো অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হয় না। এই কাজগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অদৃশ্য থেকেছে; যদিও এই কাজগুলো ছাড়া জীবন ধারণ এবং সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করা অসম্ভব।
কিন্তু বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, যার মূল ফোকাস মুনাফা, বাজার ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি জীবন-জীবিকার জন্য করা কাজের কোনো স্থান নেই। এই অস্বীকারের মধ্যেই রয়েছে নারীর প্রতি বৈষম্যের ভিত্তি এবং নারীর কাজকে গুরুত্ব না দেওয়ার চিন্তা। পলিটিক্যাল অর্থনীতি নারীপ্রশ্নকে শ্রেণির প্রশ্নের আওতায় নিয়ে আসতে চায়; আর পুঁজিতান্ত্রিক পুরুষতন্ত্র নারীপ্রশ্নকে অস্বীকার করে। মারিয়া আর ভেরোনিকা তাদের এই চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং দাবি করেছেন যেন নারীর কাজের মূল্যায়ন করে অর্থনীতির চিন্তাভাবনা ও নীতিনির্ধারণের আওতায় আনা হয়।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র কৃষকদের নিয়ে নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সাল থেকে। নয়াকৃষি আন্দোলন শুধু সার-কীটনাশক বন্ধ করার আন্দোলন ছিল না, এর প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করা। নয়াকৃষির ভাবনায় প্রকৃতিকে শুধু খণ্ড খণ্ডভাবে বুঝলে হবে না, বুঝতে হবে অখণ্ড ও সামগ্রিকভাবে। প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও বুঝতে হবে। প্রকৃতিকে দখলদারি, হানাদারি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে মানুষসহ সকল প্রাণ, প্রাণিকুলের বিকাশ অর্থাৎ সৃষ্টির অসীম সম্ভাবনার বিবর্তন নিশ্চিত করাই নয়াকৃষির চর্চা ও রাজনীতি। নয়াকৃষি দেশে-বিদেশে যারা ইকোলজিক্যাল এগ্রিকালচার ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছেন তাদের কাছে নব্বইয়ের দশকেই পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তাই আমরা Diverse Women for Diversity-তে যুক্ত রয়েছি।
নয়াকৃষি শুধু একটি কৃষি পদ্ধতি নয়, এটি একটি আন্দোলন। তাই হাজার হাজার ক্ষুদ্র কৃষক যারা জীবন-জীবিকার অংশ হিসেবে কৃষি কাজ করেন তারা অনেক মায়া-মমতায় জমি, বীজ, পানিকে দূষিত হতে দেন না। নারী অনেক যত্ন স্থানীয় জাতের বীজ রক্ষা করেন যার সঙ্গে মাটি ও পরিবেশের মিল রয়েছে। মিল রয়েছে তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক নিয়ম-নীতির। যেমন বিন্নি ধান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার, বিশেষ করে বিয়ে-শাদির জন্য দরকার হয়। অন্যদিকে যে গ্রামে তাঁতি আছে এবং কৃষক জানে কোন ধানের মাড় শাড়িতে হবে। নারী পরিকল্পনা করে ছেলেমেয়েদের জন্য পিঠার ধান লাগবে, মেহমান ও মেয়ের জামাই এলে পোলাও-পায়েসের সুগন্ধি ধান লাগবে; তাছাড়া আছে ঈদ, পূজা এবং নানা রকম ধর্মীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব। ভাত ছাড়াও আমরা মুড়ি, চিড়া, খৈ খাই। তাই নয়াকৃষির কৃষকদের হাতে সংগ্রহ আছে প্রায় ২৭০০ জাতের ধান। তাছাড়া রয়েছে সবজি, ডাল, মসলা, ফলের নানান জাত। নয়াকৃষি নারীদের একটা স্লোগান আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় হয়েছে, তা হচ্ছে, ‘বোনেরা বীজ হাতছাড়া করবেন না।’
কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফের নব্য উদারনৈতিক উন্নয়ন নীতির অধীনে তথাকথিত আধুনিক কৃষি এসে বীজের ধরন বদলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের ল্যাবরেটরিতে উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধানের বীজ, যার সঙ্গে ব্যাপক রাসায়নিক সার, কীটনাশক, মাটির তলার পানি ব্যবহার করতে কৃষকদের বাধ্য করা হলো। কৃষকরা যেসব হাজার হাজার স্থানীয় জাতের বীজ ব্যবহার করতেন তা গুরুত্বহীন হয়ে গেল, ক্রমে হারাতে শুরু করল। এখন উচ্চফলনশীল বীজের পর নতুন ব্যবসা শুরু হয়েছে হাইব্রিড বীজের। ধান ও সবজিতে দেওয়া কীটনাশক কোম্পানিগুলো হাইব্রিড বীজের ব্যবসা করছে এবং নিজেদের কীটনাশক বিক্রি করছে। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। চারদিকে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পরিবেশ দূষণ বাড়ছে, হাঁস-মুরগি পালন করা যাচ্ছে না, গরুর খাদ্যের অভাব ঘটছে। মানুষের রোগ-বালাই বেড়ে যাচ্ছে- ক্যান্সার, কিডনি রোগ এখন ঘরে ঘরে।

ডাইভার্স উইমেন ফর ডাইভারসিটি গঠনের শুরুর দিকে ড. বন্দনা শিবা, ড. মারিয়া মিজ, ড. ক্লোডিয়া ভন ডেয়ারহফের মতো নেত্রীরা বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং নয়াকৃষির কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। নয়াকৃষির নারী কৃষকরা কীটনাশকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বলেছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন- কীটনাশক যদি ফসলের জন্য উপকারীই হবে তাহলে এটাকে ‘বিষ’ বলা হয় কেন? এই বিষ তাদের শরীর এবং পুরো পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। এককাট্টা ফসল নয়াকৃষির কৃষকরা পছন্দ করেন না। বাঙালি বলে আমাদের মূল খাদ্য ভাত হলেও ধান চাষ এককাট্টা করতে হবে কেন? বাংলাদেশের মানুষ তো শুধু ভাত খায় না, সঙ্গে শাকসবজি, ডাল, মাছ, মাংস সবই খায়। তাহলে শুধু ধানের এককাট্টা উৎপাদন বাড়ালে অন্য খাদ্য হারিয়ে যাবে এবং এমন ধান উৎপাদন করা হচ্ছে যার জন্য সার-কীটনাশক অধিক পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে; এক সময় জমি বিক্রি করে দিয়ে তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। তারা বাধ্য হয়ে ঢাকা শহরে রিকশা চালানো কিংবা কোনো কলকারখানায় কাজ করছে। কৃষককন্যা শহরে গার্মেন্ট কারখানার সস্তা শ্রমিক হচ্ছে আর তরুণ ছেলেরা যাচ্ছে প্রবাসী শ্রমিক হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। কৃষি ধ্বংস করে শিল্প-কলকারখানা করাকেই উন্নয়ন বলা হচ্ছে।
ডাইভার্স উইমেন ফর ডাইভারসিটির সদস্যরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। তাদেরও প্রায় একই কাহিনি।
কৃষির সঙ্গে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্য। বাংলাদেশের মতোই অনেক দেশে জেনেটিক্যালি মডিফাইড (জিএম) ফসল চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের ওপর। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ও ব্রাজিলের সদস্যরা বর্ণনা করলেন জিএম গমের কথা, ভারতে জিএম সরিষা, বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনে বিটি বেগুন এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জিএম ধান বা গোল্ডেন রাইস চাপিয়ে দেওয়ার কথা বললেন অনেক ক্ষোভের সঙ্গে। সব দেশেই জিএম ফসল প্রবর্তনকারী কোম্পানির কেচ্ছা হচ্ছে- তারা নাকি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা দেবে এবং কীটনাশকের ব্যবহার কমাবে। ইকোফেমিনিস্ট মেনিফেস্টোতে পরিষ্কারভাবে এই মিথ্যা বয়ান নাকচ করে দেওয়া হয়। বরং দেখানো হয় যে সব দেশের সরকার নিজ দেশের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতে চেয়েছে, কৃষকের অধিকারের কথা বলেছে এবং নিজ দেশের বীজের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অনড় থেকেছে, তাদেরকে প্রভাবশালী এগ্রোবিজনেস ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। যেমন মেক্সিকো যখন জিএম ভুট্টা ও গ্লাফোসেট বন্ধ করতে চাইল, তখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বায়ার-মনসান্তোর পক্ষে মামলার হুমকি দিল। যদিও মেক্সিকো সরকার তা জোরালোভাবেই মোকাবিলা করেছে।
জিএমবিরোধী প্রতিরোধ চলছে ভারত, বাংলাদেশ, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকায়। কিন্তু প্রায় সব দেশেই কোম্পানির স্বার্থে করা অন্যায় বীজ নীতি, খাদ্য নীতি দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে। এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও মেনিফেস্টোতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, ‘আমরা সারা বিশ্বে বীজের স্বাধীনতা এবং খাদ্যের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরাপদ খাদ্য এবং সুস্থ বীজ রক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ থাকব।’
প্রাণবৈচিত্র্য পুরো মেনিফেস্টোর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে। কিন্তু এই প্রাণবৈচিত্র্য শুধু গাছ-পালা, পশু-পাখির বৈচিত্র্য নয় বা এমন কিছু নয় যার সঙ্গে মানুষের জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এই প্রাণবৈচিত্র্যের অর্থ হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক লেনাদেনার সম্পর্ক। এর অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ দিক আছে, প্রজাতি ও জাতের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি আবাসের বৈচিত্র্য, মানুষের জ্ঞানের বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য- সবকিছু মিলেই প্রাণবৈচিত্র্য।
নারীর জ্ঞান বিভিন্ন সামাজিক অবস্থায়, সাংস্কৃতিক পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয়। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে গল্প, গান, চিত্রকলা ও নিজের নানি-দাদির কাছে থেকে শিখে নেওয়া। নিরক্ষর হলেও জ্ঞানের আদান-প্রদানে কোনো সমস্যা হয় না। মেনিফেস্টোতে এই জ্ঞানকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নিজ নিজ পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নারীরা যে ধরনের
কৃষির চর্চা করছেন এবং তাদের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন- সেটাই তাদের শক্তি এবং সেভাবেই তারা প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আবাদি এবং যা আবাদ করা হয়নি, অর্থাৎ অনাবাদি বৈচিত্র্যময় খাদ্য, ঘর বানাবার সরঞ্জাম, সুতা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দ্রব্য গ্রামের আনাচেকানাচে পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এখানকার জনগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটাতে আবাদি জমি ছাড়াও খোলা সাধারণ জমি বা ইংরেজিতে কমনল্যান্ড, জলাশয়, পাহাড় থেকে সংগ্রহ করে। এ অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু এই বৈচিত্র্য শুধু সেখানেই পাওয়া যায় যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে একটি সুন্দর সম্পর্ক বজায় আছে।

ইকোফেমিনিস্ট মেনিফেস্টো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বিশ্বের ৮০% প্রাণবৈচিত্র্য, যা অবশিষ্ট আছে, তা পাওয়া যায় আদিবাসীদের অঞ্চলে। অর্থাৎ তারাই এই বৈচিত্র্য ধরে রেখেছেন। এখন সময় হয়েছে নারীদের কথা শোনার, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র কৃষকদের কথা শোনার- কারণ তারাই গাছ-গাছালি, বীজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ধরে রেখেছেন; তারাই এই ধরিত্রীর যত্ন করছেন, তার সঙ্গে সখ্য করে চলছেন। আমাদের খাদ্যই তো আমাদের জীবন, আমাদের তা রক্ষা করতে হবে এবং সেটা করতে হলে আমাদের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং জ্ঞানভিত্তিক বৈচিত্র্য বাড়ানোর চর্চাও করতে হবে। আমরা আমাদের সাধারণ সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, বেঁচে থাকার জ্ঞান চর্চা, মানুষের কল্যাণের বিজ্ঞান চর্চা করে যাব। এ সবই ইকোফেমিনিস্ট এবং আদিবাসি জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তি।
প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাণের আবাস ধ্বংস করা ঘোরতর অপরাধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই অপরাধের নাম দেওয়া হয়েছে ইকোসাইড বা পরিবেশ ও প্রাণ হত্যা। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে যুক্ত আছে কীটনাশক, আগাছানাশক, রাসায়নিক সারের উৎপাদনকারী এবং ব্যাপকভাবে এককাট্টা ফসল প্রবর্তন। অতি প্রক্রিয়াজাত করা কারখানায় খাদ্য উৎপাদনের কারণে এবং দীর্ঘ পথ পরিক্রমণের কারণে খাদ্যের গুণ ও পুষ্টি নষ্ট হচ্ছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি ও অ-সংক্রামক রোগ যেমন হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার রোগ বেড়ে যাচ্ছে।
মেনিফেস্টো খুব কঠোরভাবে সকল প্রকার কৃত্রিম ও কারখানাভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনের সমাধানকে নাকচ করছে। ডাইভার্স উইমেন ফর ডাইভারসিটি কোনো প্রকার জিন এডিটিং এবং ফসল ও গবাদিপশুর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা বিরোধিতা করে। এগুলো খাদ্য নয়, এগুলো নকল এবং মেকি খাদ্য যা তৈরি করা হচ্ছে শুধু কোম্পানির মুনাফার জন্য। আমরা সকল প্রকার দূষণ, বিকৃতি এবং খাদ্যের ওপর দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানাই।
মেনিফেস্টোতে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থানীয়, বৈচিত্র্যময় এবং প্রাণের আবাস রক্ষা করে খাদ্য উৎপাদনের আহ্বান জানানো হয়। আমরা খাদ্য ব্যবস্থার বৈচিত্র্য চাই, বীজের বৈচিত্র্য চাই, অর্থনৈতিক জীবনযাপনের বৈচিত্র্য চাই। আমাদের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের বৈচিত্র্য আছে এবং সেটাই আমাদের শক্তি।
মেনিফেস্টোতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়, ‘আজ নারীরা আবার বীজের স্বাধীনতা এবং খাদ্য সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনের অগ্রদূত হয়ে উঠেছেন। ইতিহাসের এই কঠিন সময়ে, নারী অধিকার রক্ষার বিভিন্ন আন্দোলন চলছে। কিন্তু ডাইভার্স উইমেন ফর ডাইভারসিটি সারা বিশ্বের মাঠ পর্যায়ের আন্দোলনকারী থেকে শুরু করে কৃষক, পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, পণ্ডিত এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের নারীদের একত্র করেছেন বীজ ও খাদ্য সার্বভৌমত্বের নতুন বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক উদাহরণ ও অর্থ সৃষ্টি করার জন্য।’ এ সংগ্রাম চলবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ